আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক।৬৫০০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে আমাদের বাংলাদেশে। অনেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিকল্প হিসেবে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করান।কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা এই কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোও কি পারছে মানসম্মত ও বাস্তব শিক্ষা প্রদান করতে?
হয়। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মত একই কারিকুলাম ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়েই শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বাংলাদেশের গর্ব ও নামকরা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে মাথা উচু করে রয়েছে।
শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানটি ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এ বিদ্যালয়টি তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৮৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন।২০০২ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয় ।আবাসিক-অনাবাসিক মোট ১২৩২ জন ছাত্র/ছাত্রী এ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সৃজনশীলতায় মাধ্যমিক-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও সেরা একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্বপ্ন তৈরির স্থান যা স্বপ্ন দেখতে শেখায় শিক্ষার্থীদের। কীভাবে তারা জাতীয় জীবনে অবদান রাখবে, কীভাবে মানবতার সেবা করবে। আর তাই এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি অন্যান্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা ধরনের, বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষাদান করা।গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গাইবান্ধা বাসস্ট্যান্ড হতে বাস যোগে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় যেতে হবে পরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা হতে বাস বা অটো রিক্সা যোগে ছাইতান তলা নামক স্থানে যেতে হবে। অথবা, রংপুর থেকে পীরগাছার চৌধুরানী হয়ে কিছুদূর এগোলেই বামনডাঙ্গা রেলওয়ে স্টশন। সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের ছাইতানতলার ডানদিকে শিবরাম গ্রাম। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে তৎকালীন জমিদার সুনীতিবালা দেবী এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের নামেই এর নাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ করেন, সেই সঙ্গে শিবরাম প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও জাতীয়করণ করা হয়। অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়টিই দেশব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে । অনেক বিদেশীরও নজর কেড়েছে। এটি আমাদের গর্বের বিদ্যালয়। চীন, ফ্রান্স, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য প্রতিনিধি বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন। বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালক ফ্রেডরিক টি টেম্পল, ইন্দোনেশিয়ার মজিদ ক্যাবন জাকাতা, জাপানের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ তুশিমা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন। বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখে আমি অভিভূত।’ আমরাও অভিভূত এ কারণে যে আমাদের দেশে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এমন হতে পারে! সরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয়টিতে তৈরি হয়েছে একটি দোতলা পাকা ভবন। এছাড়া স্থানীয় উদ্যোগে নয়টি আধাপাকা ভবন, একটি ইটের ঘর ও একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক ও অফিস কক্ষ পৃথক। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ রয়েছে ২০টি। বিদ্যালয়ে মোট ২৫টি টয়লেট, দুটি স্টোররুম, একটি কাপড় ইস্ত্রি করার রুম, তিনটি পানির পাম্প ও পাঁচটি নলকূপ। বিদ্যুৎ না থাকলে বিদ্যালয়ের নিজস্ব জেনারেটর চলে। এ যেন প্রাইভেট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিরা এ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো সম্প্রসারণে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন কিন্তু প্রধান শিক্ষককে তাদের কনভিন্স করতে হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকরা বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সমবায়ী কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের জন্য উপার্জন করেন, মনে হয় যেন ইউরোপীয় কোনো বিদ্যালয়! প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েও এর রয়েছে ছাত্রাবাস, যেখানে অন্য জেলার শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে একটি ডাইনিং রুম। প্রতিটি টেবিলে চারটি করে চেয়ার। পর্যায়ক্রমে দশজন শিক্ষক শিশুদের সঙ্গে ছাত্রাবাসেই থাকেন। তারা খাবারও খান শিশুদের সঙ্গে। ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকরা পর্যায়ক্রমে ডিউটি অফিসার হিসেবে ক্লাসে শিক্ষাদানের বাইরে শিক্ষার্থীদের সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন এবং তাদের সঙ্গে দৈনিক যে পাঁচবার খাবার দেয়া হয়। তিনিও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করেন। এখানকার ছাত্রাবাসটির নাম দীপশিখা। আলাদা নামকরণ হয়েছে এর বিভিন্ন কক্ষেরও। প্রতিভা, বিকাশ, পল্লবী, উল্কা, মোহনা, মনোরমা বিভিন্ন কক্ষের নাম এ ধরনের আরো বিচিত্র নাম দিয়ে আকর্ষণীয় করা হয়েছে কক্ষগুলোকে। দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসেন এবং তাদের মন্তব্য হচ্ছে এখানে থাকতে আমাদের কোনো কষ্ট হয় না। কারণ খেলাধুলা, পড়াশোনা ও আনন্দের মধ্য দিয়ে দিনগুলো কেটে যায়। তাছাড়া আপা ও স্যাররা থাকেন সব সময় তাদের সাথে। শিশুদের উপযোগী শ্রেণীকক্ষের শিক্ষণীয় ও অর্থবহ নামরকণ বিদ্যালয়টিকে আরো একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য দান করেছে। গানে গানে, পাতায় পাতায়, দীপের আলোকে, উর্মিমালা, নয়নের নীড়, মমতার মিলন প্রভৃতি একেকটি শ্রেণীর নামকরণ। একটি ঘরে নদ-নদী, আগ্নেয়গিরি, জলপ্রপাত, বন, মরুভূমি, শহর, বন্দর, গ্রামের প্রতিকৃতি থরে থরে সাজানো। আলোছায়ার ব্যবহারে এগুলোর বাস্তব পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অনেকখানি। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর প্রিয় এ কক্ষটির নাম ‘ভৌগোলিক’। পাশের উপকরণ কক্ষে আছে বাঘ, ভল্লুক, হরিণ, পাখি, গাড়ি-ঘোড়াসহ বিভিন্ন প্রাণীর মডেল ও নানা ধরনের খেলনা। এ রকম মডেল উপকরণের সংখ্যা ১হাজার। রয়েছে ১০টি গ্লোব ও ৩০টি মানচিত্র। রয়েছে দেশ-বিদেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-রাষ্ট্রনেতা প্রমুখের ছবি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরত্চন্দ্র বা সুকুমার সেনকে শিশুরা চিনে ফেলছেন এই ছবি দেখেই। ছবি দেখে শেখা মানে তাদের মনের মন্দিরে গেঁথে থাকা। সভা, ইনডোর খেলা, চিত্রাঙ্কন, সংগীত শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রার্থনা করা শিক্ষানো হয়।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। ৬৫০০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে আমাদের দেশে।সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের সন্তানদের বিকল্প হিসেবে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করাতে বাধ্য হচ্ছ।
দেশের প্রতিটি উপজেলায় হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান একটু ভালো। আর বাকি প্রতিষ্ঠান গুলোর শিক্ষার মান ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা এই কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোর চেয়ে খারাপ।
এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানে আগমন ও প্রস্তান করার সঠিক কোন সময় মেনে চলে না। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই প্রধান শিক্ষক নিজেই ফাঁকিবাজ কিংবা প্রধান হয়ে সহকারিদের পরিচালনা করার দক্ষতা নেই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের সহকারি শিক্ষক যুগযুগ ধরে একই প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণে, তাদের প্রভার প্রতিষ্ঠান প্রধানের চেয়ে অনেক বেশী।তাই প্রতিষ্ঠান প্রধান তাদেরকে সুন্দর ভাবে পাঠদান করতে পারে বলার সাহস দেখাতে পারেনা।অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ স্লিপ ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র মেরামতের সামান্য টাকার লোভ সামলাতে না পেরে কাজ করে কিংবা কাজ না করেই সরকারি টাকা নিজেই আত্মসাৎ করেন। নিজের অসাধুতার কারণে ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের কিছুই বলার যোগ্যতা রাখেন না।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর পাঠদানের উন্নয়ন ঘটানো সময়ের দাবী। কিন্তু কারো একার পক্ষে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।সবারই মনোযোগি, সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন ও আন্তরিক প্রচেষ্ঠা করলে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিবরাম স্কুলের মত কিংবা কাছাকাছি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব।
Leave a Reply